রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নৃশংস জঙ্গি হামলার চার বছর পূর্ণ হলো। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আক্রমণের এ ঘটনার পর জঙ্গি দমনে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর পরও নিত্য নতুন কৌশল নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। ভয়াবহ ওই হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একের পর এক বিধ্বংসী অভিযানে শক্তি হারাতে থাকে জঙ্গিরা। এর মধ্যেই টিকে থাকতে নানা সময় নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে তারা। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন, সদস্য সংগ্রহ ও দুটি সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলা অথবা আন্তঃযোগাযোগের মাধ্যমে শক্তি সামর্থ্য বাড়ানোর কার্যক্রম এগিয়ে নিতে চেষ্টা করছে উগ্রপন্থি সংগঠনগুলো। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে হামলা হয়। এদিন জঙ্গিরা হত্যা করে ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে।
জঙ্গিবাদ দমনে নিযুক্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট, এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) ও র্যাবের কর্মকর্তারা জানান, হলি আর্টিজানে
হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া নব্য জেএমবির নেতৃত্ব টানা অভিযানের ফলে মাঝে অনেকটাই দিশেহারা ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। তবে সর্বশেষ তারা ১১ সদস্যের দায়িত্বশীল নেতাদের নাম প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া নতুন সদস্যও সংগ্রহ করেছে। এর থেকে তাদের পুনরায় সংগঠিত হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে। এ ছাড়া পুরনো জেএমবির সঙ্গে আনসারুল্লা বাংলা টিম সমন্বয়ের মাধ্যমে মাঠে নামার একটি পরিকল্পনার নানা তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। একই সঙ্গে নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে শুরু হওয়া লকডাউনকেও কাজে লাগানোর চেষ্টা চালিয়েছে জঙ্গিরা। এ ক্ষেত্রে তারা ভার্চুয়াল প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে সংগঠনে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, কিছুটা শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা চালালেও এ মুহূর্তে বড় ধরনের হামলার শক্তি-সামর্থ্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর আছে বলে তারা মনে করছেন না।
এদিকে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪২১টি অভিযান চালিয়েছে সিটিটিসি ও র্যাব। এর মধ্যে সিটিটিসি ২৬টি উচ্চ ঝুঁকির অভিযান পরিচালনা করেছে। আর ১৭টি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে র্যাব। এসব অভিযানে মোট এক হাজার ৫৫১ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে র্যাবের হাতে এক হাজার ১৬ জন এবং সিটিটিসির হাতে ৫৩৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। এ ছাড়া এসব অভিযানে ৯৬ জঙ্গি নিহত হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘হলি আর্টিজানের পর থেকে যেভাবে জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জঙ্গিবাদবিরোধী জিরো টলারেন্স নীতি, জনগণের রুখে দাঁড়ানো তাতে হলি আর্টিজানে হামলার চার বছর পর এটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশে আপাতত হামলার আশঙ্কা অথবা জঙ্গি তৎপরতা সংগঠিত অবস্থায় নেই। বিচ্ছিন্নভাবে এবং অনলাইনভিত্তিক কিছু তৎপরতা আছে। আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদে আছি। তবে লকডাউনের সময় অনলাইনভিত্তিক তৎপরতা বেশি ছিল এটা ঠিক। তারা আপাতত হামলা চালানোর মতো সামর্থ্য রাখে না। তথাপি আত্মতুষ্টিতে না ভুগে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জামিন নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে কয়েকশ জঙ্গি সদস্য। তারা এক ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে। এ ছাড়া সিরিয়া-ইরাকে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধশতাধিক নাগরিক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হয়ে যুদ্ধ করতে হিযরত করেছিল। তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে দেশে ফিরে গ্রেপ্তার হয়েছে। অন্যদের বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য নেই কারও কাছে। তাদেরও নিরাপত্তা ঝুঁকির বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশ ফেরক এমন এক যোদ্ধা একটি স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনের হাল ধরার খবর পান গোয়েন্দারা।
সূত্র জানায়, টিকে থাকতে নানা কৌশল প্রয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কাছে বারবার ব্যর্থ হয়েছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। তাদের এখন অন্যতম কৌশল হল ‘উলফ প্যাক’ পদ্ধতি। এর মাধ্যমে এক ধরনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ববিহীনভাবে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়ও হামলা চালিয়ে নিজেদের সামর্থ্য ও অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে তারা। এরই অংশ হিসেবে রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশের অন্তত ৫টি স্থাপনায় এবং চট্টগ্রামে একটি স্থাপনায় আইইডির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রথান পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম আমাদের সময়কে বলেন, ‘র্যাবের প্রথম এজেন্ডা হল জঙ্গিবাদ দমন। সেই জায়গা থেকে আমাদের ফোকাস এক মিনিটের জন্যও সরে না। করোনা পরিস্থিতিতে সব ধরনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার মধ্যেও র্যাব জঙ্গিদের ধরেছে। এটি অব্যাহত থাকবে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘অনেক দেশে জঙ্গিবাদ ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। পাকিস্তান এর বড় উদাহরণ। তবে বাংলাদেশে এটি হয়নি। এটির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে অনেক পৃষ্ঠপোষকতা আসে। বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এটি বাড়তে থাকে, কমতে থাকে। আমাদের এখানে জঙ্গিবাদ কমে এসেছে। তবে এটি শেষ হয়নি। এটি একটি আদর্শিক বিষয়। জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হলে মানুষের মন থেকে এই আদর্শিক বিষয়টি দূর করতে হবে। এটি আসলে তত্ত্বের লড়াই, অস্ত্রের লড়াই নয়।’
Leave a Reply